ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোন মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা। ভালোবাসা আসলে সমস্ত শুভ ও সৃষ্টির শক্তি। এটা শুধুমাত্র জৈবিক বা শারীরিক ব্যাপার নয়, আবার শুধুমাত্র মানসিক বিষয়ও নয়।
 |
ছবিঃ সংগৃহীত |
প্রায় প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিন্তু কোনো না কোনো সময় ভালোবাসা এসে উঁকি দেয়। প্রেম-ভালোবাসায় যেমন একরাশ সুখ-শান্তি বিরাজ করে তেমনি প্রেম-ভালোবাসায় জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত অনিবার্য। ভালোবাসা ধনী-গরীব মানে না, ভালোবাসা জাত-কুল মানে না, ভালোবাসা কালো-সাদা মানে না, ভালোবাসা ধর্মের বাঁধন মানে না, ভালোবাসা বয়স দেখেও আসে না। একের প্রতি অন্যের প্রচণ্ড এক মানসিক আশক্তির নামই তো ভালোবাসা। জীবন আর ভালোবাসা একে অপরের পরিপূরক। এক জীবনের সাথে অন্য জীবনের পরিপূর্ণতার জন্যই কিন্তু ভালোবাসার প্রয়োজন।
স্বভাবতই ভালো দিকের উল্টো দিকে যেমন মন্দ আছে তেমনি ভালোবাসার বিপরীতে বিরহের জ্বালাও আছে। তখন আমরা অন্যের প্রতি ভালোবাসার কোনো মানেই খুঁজে পাই না। জীবনের সুন্দর ও ভালো দিকগুলো তখন আমাদের কাছে অসুন্দর হয়ে ধরা দেয়। সবকিছু কেমন জানি পরিত্যক্ত মনে হয়। এত এত ভালোবাসায় মাঝে তখন কত কত অভিযোগ! আচ্ছা ভালোবাসলে এর মাঝে ব্যস্ততা বলে কোনো বাহানা কি হানা দিতে পারে? ব্যস্ততা সবার সাথে দেখানো যায়না, কিছু স্পেশাল মানুষ থাকে যাদের সাথে আমরা, ব্যস্ত থাকলেও ব্যস্ততা দেখানো যায় না, ঠিক যেনো ভালোবাসার অতল গভীর সমুদ্রে আর তখন মনে হয় ভালবাসা যেন উঁকি মারে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে। আর যখন থাকে না, তখন..? ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী... ভালোবাসা হলো শ্বাস-প্রশ্বাস এ দেহে ... শ্বাস বিনা মানুষ কখনো বাঁচে কি'... —সম্পর্কের শুরুতে কিংবা বিয়ের আগে এমনই মধুরতম ভালোবাসাময় বাক্য বিনিময় করেন প্রেমিক-প্রেমিকারা। কিন্তু সম্পর্ক শুরু হয়ে গেলে বা বিয়ের পর?
"দুজনেই সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। দিনশেষে অপেক্ষায় থাকেন কখন সঙ্গী বা সঙ্গিনী ফোন করবে। কিন্তু অপেক্ষা ফুরায় না। অপেক্ষার প্রহর চলতে চলতে এক বুক অভিযোগ জমিয়ে ক্লান্ত মনে হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছেন! এতে করে অভিমান আরো গাঢ় হয়। একটা ফোন করার সময়ও কি মেলে না! কীসের এত ব্যস্ততা! কিন্তু চাইলেই তো অপেক্ষায় থাকা মানুষটি ফোন করে খোঁজ নিতে পারে! কিন্তু না, সেটা আর হয়ে ওঠেনা। তখন উত্তর হয় আমি কি তার রুটিন জানি নাকি, কেন আমিই সবসময় খোঁজ নেবো, আগে তো প্রতিবেলায় খোঁজ নিতো, মিনিটে মিনিটে ফোন!"- প্রায় সব জুটির মধ্যেই একটি কমন অভিযোগ থাকে! এই অভিযোগ আসতে পারে যেকোনো একপক্ষ থেকে অথবা দুইপক্ষ থেকেই। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অভিযোগটি করেন অপেক্ষায় থাকা মানুষটি। দুজনেই হয়তো পড়াশোনা করছেন অথবা দুজনেই চাকুরিজীবী। ব্যস্ততা দুজনেরই। তবু অপরপক্ষ থেকে একটু সময়, একটু খেয়াল আশা করা দোষের কিছু নয়। যদি আলাদা করে খোঁজ নাই রাখেন, যদি ব্যস্ততাকেই বড় করে দেখা হয় তবে সম্পর্ক শীতল হতে বাধ্য!
সম্পর্ক হচ্ছে একটি সুতোর মতো। যদি দুইপক্ষ থেকেই টানটান করে ধরে রাখা হয় তবেই এটি ঠিক থাকে। যেকোনো একপক্ষ একটু শিথিল হলেই সম্পর্ক আর আগের অবস্থায় থাকে না। যখন আমরা কারো সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে সম্পর্কিত হই, সেখানে আলাদা কোনো চুক্তিপত্র থাকে না, থাকে কিছু প্রত্যাশা। সে আমাকে বুঝবে, সে আমাকে চাইবে, সে আমাকে ভাববে- এমন চাওয়া না থাকলে সেই সম্পর্ক প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে না। ঝামেলা বাঁধে যখন প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি ঠিক মেলে না। তখনই সেই কমন অভিযোগ উঠে আসে- "তুমি আর আমাকে আগেরমতো বোঝো না!"
আর একারণেই কি সম্পর্কের শুরুতে একপক্ষের আগ্রহ বেশি থাকে আর সম্পর্কের পরে সেটি কমে যায়? বিশেষজ্ঞরা হয়তো সেটাকে ব্যাখ্যা করে এভাবেই বলবেন যে, একটা সময় দায়িত্ববোধের জন্য ব্যস্ততা তুলনামূলক বেড়ে যায়, আর একারণেই এই দূরত্ব। কিন্তু অপরপক্ষ তো সেটি মানতে নারাজ। তার ভাষ্যমতে, ব্যস্ততা তো আমারো আছে। তারমানে তো এই না যে আমি তোমায় মনে করছিনা বা তোমাকে ভুলেই গিয়েছি। এভাবেই মান-অভিমান-অভিযোগ চলতে থাকে আর মধুময় ভালোবাসায় তিক্ততা বাড়ে।
আপনার এতসব ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে একটু জিজ্ঞাসা করুন তো, এই যে ব্যস্ততার মাঝে যে রোদ আপনাকে ছুঁয়ে যায়, তা বুঝতে পারেন কিনা। বাড়ি ফেরার পর যে মানুষটা ঘরের দরজা খুলে তার ভালোবাসার অনুভব হয় কিনা। হয়তো বলবেন কাছের মানুষগুলোকে সুখী দেখতে চাওয়া, তাদের আর্থিক নিরাপত্তা, তাদের সুখের জন্যই তো এত আয়োজন, এত ব্যস্ত থাকা। আজ এখন ব্যস্ততাকে ভালোবেসে হয়তো একদিন কাছের মানুষগুলোকে ভালোবাসা দেয়ার ইচ্ছা অবাধে। এমনও তো হতে পারে যখন অবসর মিলবে, তখন ভালোবাসা নেয়ার মানুষগুলোর অস্তিত্বই হয়তো আর জীবনে থাকবেনা! আজ যেখানে আপনার বাড়িতে আসার অপেক্ষায়, খাবার টেবিলে, চায়ের কাঁপে, কিংবা বিছানার চাদরে যে মানুষগুলোর হাত পড়েছে, সেই হাতগুলো যদি একদিন পঙ্গু হয়ে মরে যায় কেবল আপনার অবসরের অপেক্ষায় থেকে থেকে, কেবল আপনার কাছ থেকে ভালোবাসার দুটো শেষ কথা শুনবার আশায়? ব্যস্ততা কি তবে অবসরেও মুক্তি দেবে তাকে?
আমি যদি বলি কাছের মানুষগুলোর চোখে চোখ মেলে একবার দেখুন, একটাবার তার বা তাদের হাত ধরুন, আজই খাবার টেবিলে অন্তত একবার তাদের বলুন, আপনার জীবনে সে কতটা মূল্যবান। তাহলে হয়তো বলবেন, আবেগে জীবন চলে না, জীবনে চলতে গেলে ব্যস্ত হতে হয়, আর সেই ব্যস্ততাকে ভালোও বাসতে হয়! আপনার কাছে প্রিয়জনের মূল্য নেই, কিন্তু সেই একটা-দুটো মানুষের কাছে হয়তো আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান কেউ। আপনার ভালোবাসা অকাতরে বিলিয়ে দিলে হয়তো সেটা কেবল সময়ের অপচয় বলেই মনে হবে, কিন্তু যে মানুষটা রোজ আপনার ঘরে ফেরার প্রতীক্ষায় থাকে, যে মানুষটা রোজ আপনার সুন্দর জীবনের প্রার্থনায় মগ্ন থাকে, সেই মানুষটার জীবনে আপনিই কিন্তু সময়! সেই মানুষটার জীবনে সময় মানেই ভালোবাসা! জীবনে বড় হতে পারাটা বাধ্যতামূলক, কোন কিছুর বিনিময়েই তাকে এড়ানো যায় না, কিন্তু বেড়ে উঠতে পারাটা ঐচ্ছিক। আর সেই ইচ্ছেটাকে পূরণ করার ক্ষমতা-যোগ্যতা সবার থাকে না।
ভালোবাসার জন্য আপনি কী করতে চান? এমন প্রশ্নের উত্তরে হয়তো অনেকগুলা বিষয়ে একটি লম্বা কর্মতালিকা করতে পারবেন। কিন্তু তা না করে ভালোবাসার মানুষের জন্য এমন কিছু কাজ আছে যেগুলো করা উচিত নয় সেটা আগে বুঝুন। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে অনেক সমঝোতা এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তার মানে এই নয় যে আপনি আপনার জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে সুখি রাখতে গিয়ে নিজে যন্ত্রণা ভোগ করবেন। আপনি যখন কাউকে ভালবাসবেন তখন সেই কেবল হবে আপনার চিন্তাশক্তির মালিক। তার ভালোলাগা মন্দ লাগা আপনার কাছে বিশাল ব্যাপার হবে। ছোট ছোট ব্যপার নিয়ে আপনি তার সাথে ঝগড়া করবেন। তার করা কাজগুলোতে আপনি আপনার নিজেকে খুঁজবেন, তাকে কীভাবে সুখে রাখা যায় তা খুঁজে বের করবেন। আবেগের ক্ষেত্রে আপনি অনেক কিছুই বলতে পারবেন কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে আর করতে পারবেন না। তার চিন্তাশক্তিতে আপনি নিজেকে না আপনার চিন্তাশক্তিতে তাকে রাখতে চাইবেন।
তাই রাগ, অভিমান হয়ে থাকলে শুরুতেই সেটা ভুলতে চেষ্টা করুন। ক্ষমা মানুষের একটা বড় গুণ। তবে এই গুণ রয়েছে এমন মানুষ বিরল। মুখে বললেও কাউকে ক্ষমা করতে উদারতায় টান পড়ে। সঙ্গীর আচরণ আপনাকে আহত করলেও মুখ ফুটে তা না বলায় জমতে থাকে অভিমানের পাহাড়। আর তার ফলে নিজের অজান্তেই তৈরি হয় প্রতিশোধ স্পৃহা। যার পরণতি ভয়ানক। তাই সময় থাকতে সাথের মানুষটিকে বুঝিয়ে বলুন। সম্পর্কের সজীবতা বজায় রাখতে গেলে অনবরত ভাবনা বিনিময় খুব দরকারি বলে মত মনোবিদদের। তাদের মতে, যোগাযোগের অভাব থেকেই সম্পর্কে ফাটল তৈরি হয়। আর তাতে ঢুকে পড়ে তৃতীয় ব্যক্তি। তাই অভিমান জমিয়ে না রেখে বলে ফেলুন প্রিয়জনকে।
আমাদের জীবনে ভালোবাসা আছে বলেই তো ভালোবাসার মানুষের মাঝে আমরা খুঁজে বেড়াই আমাদের মনের মাঝে সুপ্ত থাকা সকল চাওয়া-পাওয়াগুলো। আপনি কিভাবে তাকে নিয়ে কোথায় যেতে চান কি করতে চান সবকিছু থাকে এই ভালোবাসার কাছে বন্দি। ভালোবাসার কোন আকার নেই। তবে আপনি ভালোবাসাকে যেদিকে নিয়ে যাবেন আপনার সামনে থাকা সময়গুলো ঠিক সেদিকেই যাবে। ভালোবাসায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যাকে ভালোবাসেন সে আপনাকে ঠিক কিভাবে চায় সেটাও লক্ষ্য করুন! ভালোবাসায় আকাঙ্ক্ষা থাকবেই। তবে আপনি আকাঙ্ক্ষাকে ভালোবাসা মনে করছেন কিনা সেটা আগে বুঝে নিন। ভালোবাসা কোনো চুক্তিবদ্ধ দলিল নয়। তবে এটি হচ্ছে সেই যোগাযোগ মাধ্যম যাতে প্রয়োজন পড়ে না কোনো তারের কিংবা সংযোগের। মনের টানই একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস জন্ম নেয় ভালোবাসা হিসেবে। ভালোবাসায় যেমন থাকে মধুর স্মৃতি তেমনি থাকে খারাপ মুহূর্তের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতাও। আর এসব কিছুই একটি প্যাকেটে পুরেই জীবনের যাত্রা শুরু হয়। ভালোবাসা একটি পরিবারকে জুড়ে রাখার অদৃশ্য বন্ধন। ভালোবাসা কিছুটা লবণের মতো! যা ব্যবহার না করলে আপনার জীবনের স্বাদ আপনি বুঝবেন না। এই তর্ক, বিতর্কের মাঝেই বেঁচে থাকে সত্যিকারের ভালোবাসা। কারণ মান-অভিমান যতোই হোক, দিনশেষে তো সেই প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসাটাই সত্যি!
 |
ছবিঃ সংগৃহীত |
যুদ্ধ কিংবা হিংসা নয় আসলে এই পৃথিবীকে টিকিয়ে রেখেছে ভালোবাসা। ব্যস্ততা হচ্ছে জীবনের জন্য আর জীবন হচ্ছে ভালোবাসার জন্য। তাই এক্ষেত্রে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে ভালোবাসাকেই জয়ী ঘোষণা করে কাছের মানুষটিকে বলে ফেলুন ভালোবাসি সেই সাথে গানের ভাষায় বলতে পারেন-
"ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো,
তোমার মনের মন্দিরে... আমার পরাণে যে গান বাজিছে,
তাহার তালটি শিখো তোমার চরণ মঞ্জিরে..."